অফিস সেরে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে কখনও কম্পিউটারে গেম খেলি, ইন্টারনেটের অবারিত জগতে বিচরণ করি, কিংবা কখনও বা শুধুই ঘুম। কখনও আবার বালিশের পাশে অযত্নে পড়ে থাকা একটি গল্পের বই আমাকে সংগ দেয়। গল্পের বই মাঝে মাঝেই ছুটিতে যায়। সেখানে চলে আসে কঠিন কঠিন সুত্রে বাধা মোটা মোটা ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই। কিংবা খসখসে শব্দের আর্তনাদ করে ওঠা প্রাত্যাহিক খবরের কাগজ। পড়তে পড়তে কখন যেন নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ি। খোলা আকাশ তখন আমাকে ডাকেনা। তারাদের সংগী চাঁদ ও তখন অনেকটা অচেনা। তখন শুধুই ঘুম। অনন্ত চাওয়ার পূর্ণ প্রাপ্তির ঘুম।
টিউব লাইট এর দুধ-সাদা আলো জ্বলতে থাকে। জ্বলুক। কোন কোন দিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙেগ। বিরক্ত চোখে আলোটাকে জন্ম জন্মান্তরের শত্রু মনে হয়। আলুথালু বেশে নীলচে-সবুজ মশারীর দেয়ালের নিচ দিয়ে উঠে আলোটাকে হত্যা করি। ভালো লাগে। তারপর আবার সেই ঘুম। কে যেন বলেছিলো, “ঘুমাতে এত ভালো লাগে কেন? না জানি, চিরদিনের ঘুম কতই না মজার।” মাঝে মাঝে কথাটার সত্যাসত্য নির্ণয়ের সাধ জাগে। শোনা কথায় কান দিতে নেই যে! কখনও শত্রুর মত সামনে ভেসে থাকা আলোটাকে নিজ হাতে বধ করতে ইচ্ছা জাগেনা। কিংবা সহজ ভাষায় বললে, মাঝরাতে আর ঘুম ভাঙেনা। কৃত্রিম আলোটা প্রভাত সূর্যের সংগে তেজ দেখাতে চায়। কিন্তু পারেনা। পারতে দেইনা। খট করে নিভিয়ে দিই।
এখন কবিগুরুর ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়ছি আবার। তাঁর প্রতিটা শব্দের দ্যুতি আমাকে আলোকিত করে। নগন্য এই আমার পক্ষে তার লেখার আলোচনা-সমালোচনা করা তো অতিদূরের ব্যাপার, প্রশংসা করাও একপ্রকার নিকৃষ্টতম ধৃষ্টতার সমতুল্য। একটা মানুষ সারাটা জীবন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে নিজ লেখার মাধ্যমে মানব চিত্তকে আলোড়িত করে গেছেন, এখনও করছেন। ভাবতেও শিহরণ জাগে। তার নামে গোঁড়ামী প্রসূত অপবাদ শুনলে কপালের পাশের অনুভুতির শিরাটা দপ দপ করে আন্দোলিত হয়। মুষ্টি অনমনীয় হয় দূর্বিনীত আক্রোশে। বলা হয়, ধনী পরিবারের সন্তানের পক্ষে খুবই সম্ভব ছিলো সাহিত্য রচনায় বাঁধনহীন নিমগ্ন থাকা। খাওয়া পরার তেমন চিন্তা ছিলোনা তাঁর। জীবনটাকে উপভোগ করেছেন আর লিখেছেন। খুবই সহজ হিসাব! সমকালীন কিংবা পরবর্তীকালের অনেক সাহিত্য-পথিকের মত জীবন সংগ্রামের ময়দানে তাকে নামতে হয়নি। তিনি একান্ত সময় কাটানোর ছলেইই তার কলমের নিবে ছত্র লিখে দিন গেছে তাঁর! শুনলে হাসি পায়। কান্নাও পায়। রবীন্দ্র সমসাময়িক অনেকেই ছিলেন অর্থবিত্তে সমকক্ষ কিংবা আরো অনেক বেশি। তাদের ক’জন আমাদের মানসপটে বিরাজমান আজও? তাদেরও তো সে সুযোগ ছিলো। কিন্তু কবিগুরু আছেন, থাকবেন। তাঁর নিজের সৃষ্টিতে, কীর্তিতে।
তাঁর সবগুলো কাহিনী বিন্যাস-ই যে কালোত্তীর্ণ, সেটা বলা নিরপেক্ষতার পরিচয় হবেনা। কিন্তু আগের মত আবার বলছি, তাঁর ব্যবহৃত প্রতিটা শব্দের আলোকছটা নক্ষত্রের চেয়েও প্রখর। গল্পের মাঝে মাঝে নিজস্ব জীবনবোধ থেকে উতসারিত কিছু শব্দ, কিছু বাক্য আমাকে বজ্রাহতের মত চমকে দেয়। কাহিনী পিছে পড়ে রয়। মনচক্ষু খুঁজে বেড়ায় এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা সেসব মুক্তার খনি।
কাল একটা গল্প পড়ছিলাম। প্রথম কয়েক ছত্র পড়েই পড়েই উপসংহারের ধরণ কল্পনা করে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সেটা আমার ক্ষতিবৃদ্ধির কারণ নয়। আদতে কোন ক্ষতি-ই নেই এখানে। একটা প্যারাতে চোখ আটকে গেলো...
“একটা পাখিকে সুবিধামত ডালের উপর বসিয়া থাকিতে দেখিলেই শিকারীর ইচ্ছা করে তাহাকে গুলি বসাইয়া দিতে, পাহাড়ের গায়ে প্রস্তর পতনোন্মুখ থাকিতে দেখিলেই বালকের ইচ্ছা করে এক লাথি মারিয়া তাহাকে গড়াইয়া ফেলিতে - যে জিনিষটা প্রতি মুহূর্তে পড়ি-পড়ি করিতেছে, অথচ কোনো একটা কিছুতে সংলগ্ন হইয়া আছে, তাহাকে ফেলিয়া দিলেই তবে যেন তাহার সম্পূর্ণতা সাধন এবং দর্শকের মনে তৃপ্তিলাভ হয়।”
আজ এই পর্যন্তই।
অনেক দিন কিছু লেখা হয়না। শুধুমাত্র লেখার আনন্দেই লিখে ফেললাম এতটুকু!