-
নীলাকাশের সূর্য ডুবিয়া যাইবার ও বহুক্ষণ পর যখন আকাশ ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিবার চক্রান্ত করিতেছিলো ঠিক সেই মূহুর্তে এক নিঃসঙ্গ হাটুরিয়া গৃহাভিমুখে ফিরিয়া আসিতেছিলেন। ইহা উল্লেখ করা যারপরনাই অনাবশ্যক যে রাত্রিকালে পল্লীপথ যথেষ্ট আশংকামুক্ত নহে। সেই কারণেই উক্ত ব্যাক্তি পদযুগল দ্রুতপদে সঞ্চালন করিতে মনস্ত করিলেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদীতে ভারাক্রান্ত ‘ঝুড়ি’জাতীয় একখানা বস্তু তাহার মস্তকোর্ধ্বে উপস্থিত থাকিয়া তাহার শোভা শতক্রমে বাড়াইতেছিলো।
জাতস্বস্তিপুর পল্লীর পার্শ্বদেশ দিয়া নিজ পল্লীতে আসিতে হইলে সুবিশাল প্রান্তর পার হইতে হয়। সেই প্রায়ান্তহীন প্রান্তরে ইক্ষু আবাদ করিয়া কৃষিজীবীগণ আপনাদিগের মিস্টান্নের প্রয়োজন মিটাইতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিয়া থাকেন। অন্ধকার রাত্রিরে পরমেশ্বরের অযুত নামসমূহ স্মরণ করিয়া হাটুরিয়া ইক্ষুক্ষেতের গা ঘেষিয়া প্রবাহিত তন্বীকটিসম-সরু পথ অবলম্বন করিবার প্রয়াস পাইলেন।
নানারূপ প্রাত্যাহিক দূর্বোধ্য-বক্র ইহলোকিক চিন্তা চেতনায় নিমগ্ন থাকিয়া তিনি পার হইতে ছিলেন বলিয়া অশরীরী জীবসমূহ সম্মুখে তো নহেই, এমনকি তাহার মানসপটে ও আসিতে সাহস করিলোনা। তিনি নির্বিঘ্নে চলিতে লাগিলেন। বিপুলাকার ইক্ষুক্ষেতের আনুমানিক মধ্যবর্তী বিন্দুতে আসিয়া তিনি হঠাৎ অসংযুক্ত উপলখন্ড কর্তৃক অষ্টবক্রক্রীড়াপূর্বক গতিপথ হইতে বিচ্যুত হইলেন। সূচিভেদ্য দূর্গন্ধ তাহাকে নাড়াইয়া দিলো। মৃদু চন্দ্রালোকে স্বীয় নাসিকাযন্ত্রের বিশ্বস্ত সহায়তায় তিনি সুনিশ্চিত অনুমান করিতে পারিলেন, ইক্ষুক্ষেতের নিকটবর্তী বৃহত শৃগাল-গোষ্ঠীর কতিপয় বিকৃতমস্তিষ্ক-অর্বাচীন সদস্য পথিমধ্যে কর্ম সারিয়া গিয়াছে যাহা তাহার মসৃণ যাত্রাপথে বিঘ্ন ঘটাইবার জন্যে সর্বোতভাবে দায়বদ্ধ! বসুধাপালিত সকল শৃগাল প্রজাতির প্রতি আদিম কটুকাটব্য বর্ষণপূর্বক তিনি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সবজীসমূহ গুছাইতে মনোনিবেশ করিবার আকাংখা পোষণ করিলেন। তথাপি মল-জর্জরিত তরিতরকারী বহন করিয়া গৃহে গমন করা ইতর শ্রেণীর কর্ম বিবেচনা করিয়া তিনি স্ব-গ্রাম ধীমানগঞ্জে অবশিষ্ট দূরত্ব রিক্তহস্তে নির্বিবাদে পৌছাইয়া গেলেন।
কিয়ৎকাল পরেই অপর এক হাটুরিয়া পূর্বোল্লেখিত পথ অবলম্বন করিয়া নিজ বাটিতে আসিতেছিলেন। জনমানবহীন অকুস্থলে পৌছাইয়া তিনি ঝুড়িসমেত সবজী দেখিতে পাইলেন। লৌকিক ধর্মকর্মে অতিরিক্ত বিশ্বাসহেতু অঞ্চলান্তরে তাহার অনেক অপ-খ্যাতি বর্তমান ছিলো। স্বভাবতই তিনি ভাবিয়া বসিলেন, নিশ্চিত ইহা কোন পরমাত্মার স্মৃতি বিজড়িত এই স্থান। ভাবনামাত্রই তিনিও ঈশ্বরের নাম স্মরণ করিয়া কিছু সবজী ও চাউল সমর্পন করিলেন এবং অশরীরীদিগের অস্তিত্ব কল্পনা করিয়া উক্ত স্থান দ্রুত পরিত্যাগ করিলেন।
তৃতীয় অপর এক ব্যাক্তি ধ্রুম্রশলাকায় সুখটান দিয়া জনপ্রিয় বৈদেশিক সুর নিজ স্বরধ্বণীতে ভাঁজিতে ভাঁজিতে পূর্বোক্ত ব্যক্তিদিগের পদাঙ্ক কিঞ্চিত দূরত্ব বজায় রাখিয়া অনুসরণ করিতেছিলেন। অমার্জনীয় অন্যমনস্কতার ক্ষতিপূরণবাবদ তিনিও ঘটনাস্থলে হোচট খাইয়া নিজেই মাখামাখি হইয়া যান! চক্ষু দুইটি উন্মিলিত করিয়া যথাস্থানে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদীর সংগ্রহ দেখিয়া ধারণা করিলেন, পাপিষ্ট হৃদয়ে পূতপবিত্র স্থানকে যথেষ্ট পরিমান সম্মান না দিয়া অতিক্রম করিবার মনস্ত করিয়াছিলেন বলিয়া সৃষ্টিকর্তা নিজেই খড়গহস্ত হইয়াছেন। স্খলনের শাস্তি অত্যাল্পের উপর দিয়া গিয়াছে, ইহা ধারণাপূর্বক কিঞ্চিত অর্থ সমর্পণ করিয়া বায়ুবেগে স্থান ত্যাগ করিলেন।
ইহার পর যিনিই উক্ত স্থান অতিক্রম করিয়া যান তিনিই স্থানটিকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ, ঐশ্বরিক স্থান মনে করিয়া কিছু না কিছু সমর্পন করিয়া যান। ফলে উক্ত স্থানে অনতিবিলম্বে কেউকারাডংসম পর্বতাকার স্তুপ জমিয়া গেলো...!
এক অল্পবিস্বাসী ধূর্ত সন্যাসী উক্ত পথ প্রায়ই অতিক্রম করিতেন। তিনি সমসাময়িক স্তুপাকার নৈবদ্য এবং শৃগালের অবদান অবলোকন করিয়া মূল ঘটনার সঠিক অনুমান করিতে সমর্থ হইলেন। সন্যাসব্রতে তাহার অকথ্য দূর্দিন যাইতেছিলো। বর্তমানকালের মানবসন্তানেরা ধর্মকর্ম ছাড়িয়া পিশাচে পরিনত হইবার সাধ করিতেছে। তাহাদের আত্মিক উন্নতিকল্পে, নিমেষমাত্র বিলম্ব না করিয়া তিনি রক্তিম বর্ণের একখানা বস্ত্রখন্ড সাজাইয়া যথাস্থানে আসন লইলেন।
প্রকারান্তরে প্রতিষ্ঠা হইলো অত্র অঞ্চলের স্বনামধণ্য তীর্থস্থান যাহাকে কতিপয় দুষ্টব্যাক্তি ‘শেয়াল বাবার মাজার’ বলিয়া সম্মোধন করিয়া প্রায়ই অন্ধবিশ্বাসীদিগের বিরাগ ভাজন হইয়া থাকেন!
***পাদটিকা ১*** সকল মাজারই যে এই ভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা বলা অন্যায় হইবে। তথাপি লোকসমাজে এই রূপ প্রচলিত কাহিনী শ্রবণ করিয়া ইহা ধারণা করা যাইতে পারে, কতক মাজার এইভাবেই উন্থিত হইয়াছে!
***পাদটিকা ২*** প্রজ্ঞা-প্রমাদজনীত ‘গুরুচন্ডালী দোষ’ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখিবার প্রার্থনা করিতেছি!
বৃহস্পতিবার, ৩০ আগস্ট, ২০০৭
দরগাহ-ই-ফক্স!
রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০০৭
তার মন তো বুঝলাম!
-
ব্যাচেলর বাসা!
প্রমথেশের বাসা। প্রমথেশের মত আরো কয়েকজনের বাসা। কর্তৃপক্ষ ‘খেদিয়ে’ বিদায় করার পর হোস্টেল ছেড়ে প্রথম মাথা গোজার ঠাঁই হলো এই চার রুমের বাসাটা। বাসাটা বখশীবাজারে। কিন্তু ক’দিন পরেই কারো চাকরী হলো উত্তরা আর কারো যাত্রাবাড়ি! তাই উত্তর দক্ষিণের এই মিলনমেলা বেশিদিন স্থায়ী হচ্ছেনা আর! বাসাটা ছাড়তে হবে!
বাড়িওয়ালাকে জানানো হলো। বাসার সামনে ঝুলতে লাগলো ... ‘TO-LET’!
অফিস শেষে বাসায় বিছানায় বসে রাত নয়টার পর পত্রিকা পড়ছে প্রমথেশ। খুট করে একটা শব্দ হতেই পেপারটা নামিয়ে দেখে মধ্যবয়সী জলজ্যান্ত এক মহিলা সামনে দাঁড়িয়ে! এত রাতে ব্যাচেলর বাসায় মহিলা! সংগে অবশ্য একটা সাত-আট বছরের বাচ্চাও আছে। একটু আশ্চর্য প্রমথেশ! ব্যাপার কি? মহিলা বললো, “আমি বাসা ভাড়া নেবো। দুপুরে এসেছিলাম বাসা দেখার জন্য। কিন্তু এখন আবার ভালো করে দেখতে এলাম।” প্রমথেশ তাকে নিয়ে বাসাটা দেখাতে লাগলো। চার রুম- দুই বাথ- কিচেন -বারান্দা সবই আছে! মহিলাটি সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলো।
জবাকে ফোন করতে হবে। এই যা! মোবাইল ফোনটা কোথায়? বিছানার উপরই ছিলো ওটা! গেলো কোথায়? বিছানা বালিশ তোষক উল্টে পালটে ‘সদরঘাট’! মোবাইলটা অদৃশ্য! সম্ভবত এই মোবাইলটাই মহিলার সন্তুষ্টির কারণ! কিন্তু কিভাবে সম্ভব?! প্রমথেশ তো সবসময় তার সংগেই ছিলো! কিন্তু মহিলার বাচ্চাটা? ওই ‘পিচ্চি’ ই আলতোভাবে সরিয়েছে মোবাইলটা! ‘পূর্ণ’ টাকাকে টহল দিতে গিয়ে ‘রেজগি’র দিকে নজর দেয়া হয়নি ঠিকমত!
পরদিন অফিসে এসে প্রমথেশ বলছিলো তার এই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা।
মোবাইল হারানোয় সহানুভুতি পেলো অনেক! সংগে আরো যা যা শুনলো... শরীফভাই বললেন, “আপনার তো জরিমানা হওয়া উচিত! এত রাতে এক মহিলাকে বাসায় ঢুকতে দিয়েছেন! তাও আবার ব্যাচেলর বাসা! কত ‘কি’ হয়ে যেতে পারতো! এ তো পুলিশ কেস!” প্রমথেশ হতবাক! মাইনুল ভাই আরো এগিয়ে গেলেন, “যদি ‘নারীঘটিত’ কেসে পড়তে তাহলে তোমার মিনিমাম পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ হয়ে যেতো। মোবাইলের দাম কত? দশহাজার? বাকি চল্লিশ হাজার টাকার পুরোটা না হলেও তো উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের খাওয়ানো উচিত !”
প্রমথেশ মোবাইলের শোক ভুলতে আরম্ভ করলো এতক্ষণে! ‘জোস’ একটা দার্শনিক ডায়ালগ ছাড়লো, “চোর চুরি করলো তো কি হয়েছে, চোরের মন তো বুঝলাম!”
শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০০৭
নাম রহস্য
-
আমার এক মামা আছে... মায়ের দূরসম্পর্কের ফুফাত ভাই... তার নাম ‘হবু’। যখন অপরিচিত কারো সামনে হবুমামাকে নিয়ে আলোচনা করা হয়...তখন সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে...মামা আবার হবু হয় কিভাবে? হবু ভাবী...হবু মামী...হবু খালু...হবু জামাই এমনকি হবু শ্বশুর-শাশুড়ি ও হয়! তাই বলে মামা-খালা কি হবু হয়?
তবে মূল কাহিনী হল তার ‘ভালো’ নামে মানে ‘কেতাবী’ নামে!
গোড়া থেকে ‘সাফসুতরো’ করেই বলি। ছোট বেলায় তিনি নাকি খুবই হাবাগোবা টাইপের ছিলেন। তাই সমবয়সীরা তাকে ডাকতো... ‘হাবলুম মীমমাসাদ’! হাবা থেকে ‘হাবলুম মীমমাসাদ’! ফাজলামো করে ডাকতে ডাকতে ওটাই হয়ে গেলো আসল নাম! তার পন্ডিত-অজ্ঞ ‘পিতা-প্রাতঃস্মরণীয়’ ... স্কুলে ভর্তির সময় নাম দিলেন ‘মোহাম্মাদ মীমমাসাদ’! কি চমৎকার নাম! নামের উৎস পবিত্র কোর’আন শরিফ! ‘সুরা লাহাব’ থেকে ডাইরেক্ট কপি-পেস্ট! ‘সহি’ আরবী নামে ছেলের নামকরণ! মারহাবা!!
হবুমামা এখন অনেক বড় হয়েছেন। বোকাসোকা সেই নাদুনুদুস ছেলেটি আর নেই। তিনি একজন BCS ক্যাডার! তবে মীমমাসাদ নামটা রয়েই গেছে! ‘মীমমাসাদ’ কি বস্তু? খায় না পিন্দে? শব্দটার মানে ‘খেজুরকাঁটা দিয়ে তৈরী দড়ি’ যেটা প্রাচীন আরবে কাউকে শাস্তি দেবার জন্য ব্যবহৃত হতো!
আমার বন্ধু ...রাশেদ। প্রাইমারী স্কুলে ভর্তির খাতায় নাম এন্ট্রির সময় স্যার জিজ্ঞাসা করলেন,
নাম কি?
রাশেদ।
রাশেদ কি?
রাশেদ কিছুনা।
কিছুনা মানে?
স্যার, শুধু রাশেদ। আগে পিছে কিছু নাই।
তাহলে তো তোকে একটা ভালো নাম দিতে হয়। যা, তোর নাম দিলাম রাশেদুল ইসলাম।
স্যার?
কি?
স্যার, আমার নাম দেন রাশেদ খান মেনন!
দেয়া যাবেনা
তাহলে স্যার, রাশেদ চৌধুরী?
উঁহু, তাও দেয়া যাবেনা
কেন, স্যার?
আগে দুইজনকে ওই দুইটা নাম দিয়ে দিয়েছি। একই নাম দিলে পরে আবার গ্যানজাম বেঁধে যাবে। যা এখন ভাগ। ওই পরে কে আসিস? সামনে আয়...!
রাশেদ এখন মাঝে মাঝে মজা করে বলে...ইস, কিছুক্ষণ আগে স্কুলে গেলে রাশেদ বিশ্বাস নামের ছেলেটা রাশেদ খান সাহেব হয়ে যেতো! হে হে হে!
আমার এক দূরসম্পর্কের খালার স্কুলের নাম ছিলো......
মোছাম্মাত খালেদা খাতুন, পিতা আব্দুল খালেক বিশ্বাস।
একই ক্লাসের তার এক বান্ধবীর নাম ছিলো......
মোছাম্মাত খালেদা খাতুন, পিতা আব্দুল খালেক বিশ্বাস!
এই নিয়ে প্রায়ই গোলমাল বেধে যেতো! একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা! দেখা গেলো, পরীক্ষায় দুজনের কেউ শুন্য পেলে আরেকজন ঝাড়ি খেতো! আবার একজনের বয়ফ্রেন্ডের চিঠি আরেকজন খুলে লজ্জায় লাল হয়ে যেতো! এরকম অবস্থায় দু’জনেই অস্থির! নামের এই আজন্ম ‘পাপ’ খন্ডানোর সুযোগ এলো ক্লাস নাইনে SSC পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময়!
রেজিস্ট্রেশন শেষে টিফিনের সময় দুই বান্ধবী মিলে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলো। খালা বললো, “খালেদা, প্রব্লেম সলভ’ড। রেজিস্ট্রেশনের সময় আমার নাম চেঞ্জ করে দিয়েছি!” বান্ধবীর চোখে আতঙ্কের ছাপ, “কি দিয়েছিস?”
“খালেদা পারভীন!”
বান্ধবীর হাত থেকে মুড়ি মাখানো প্যাকেটটা পড়ে গেলো!
ঠিক একই চিন্তা করে বান্ধবীও নাম চেঞ্জ করেছে! আর নামও নিয়েছে খালেদা পারভীন! একেই হয়তো বলে টেলিপ্যাথি! বাপের নামটা চেঞ্জ করে দিলেও হয়তো মিলে যেতো আবার!!
আমার নিজের নামটার উৎপত্তিটাও বেশ মজার। ৮ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তির সময় দাদার পছন্দ করা একটা ‘গতানুগতিক’ নাম দিতে যাচ্ছিলেন আব্বা! ভর্তির ঠিক আগ মুহুর্তে আমি ‘ভেটো’ দিলাম! এই ‘মান্ধাত্বা’ নাম আমাকে ঠিক ‘স্যুট’ করছেনা! আমার কান্নাকাটি আর জোরাজুরির ফলে আব্বা একটা নাম ইন্সটান্টলী প্রোডিউস করলেন! সেটাই এখন আমার নাম!
শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০০৭
...জলেই গেলো!
কিভাবে লোকটার বর্ণনা দেয়া শুরু করি?
লোকটা তোমার আমার মতই দেখতে। বাংলাতেই কথা বলে। কি যেন নাম তার? ওহহো! তার নামটা তো খেয়াল নেই। তবে হ্যাঁ, তার একটা পরিচয় আছে। যদি কখনও গ্রামে গিয়ে তার বাড়ি খুঁজতে যাও, তাহলে তালগাছটার নিচে মুদি দোকানটায় জিজ্ঞেস করবে, কিপটুসের বাড়ি কোথায়? তাহলে সবাই আগে তোমার দিকে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকবে। তারপর অবশ্য দেখিয়ে দেবে সঠিক পথ! কিন্তু তাদের গরম রাজনৈতিক আলোচনার অকাল মৃত্যু ঘটে সেখানে কিপটুস আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে! তোমাকে নিয়েও অনেক জল্পনা কল্পনা হবে! কে এই অকালকুষ্মান্ড!?
কিন্তু কে এই কিপটুস?
আগেই তো বলেছি সে তোমার আমার মতই সাধারণ মানুষ! উফ! এখনও তার নামটা মনে পড়ছেনা। নামে কিবা আসে যায়? তার একটা নাম তো ছিলোই। বাপমায়ের দেয়া নাম তো সবারই থাকে। কিন্তু সেটা হারিয়ে গেছে আর কিপটেমি মানে কৃপণতায় প্রভূত ‘সুনাম’ অর্জন করায়! দু’পয়সা বাচাবার ইচ্ছে কার না থাকে? কিন্তু কিপটুসের মত এমন বোধহয় ভূ-জগতে আর কেউ নেই! এই তো সেদিন, সন্ধ্যার পর হাট থেকে ফেরার সময় হাত থেকে একটা চার আনা ফসকে পড়লো বটগাছের গোড়ায়। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কিছুই স্পষ্ট দেখা যায়না! কিন্তু পয়সা তো ফেলে যাওয়া যায়না। আবার টর্চ জ্বালানো ও বাড়তি ব্যাটারী খরচ। সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে... সকালে সূর্য উঠার পর পয়সাটা ঝিলিক দিয়ে তার অস্তিত্ব জানালেই কিপটূস ওটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো। এরকম অনেক ঘটনা লোকমুখে ফেরে। তাই তার নামই হয়ে গেলো কিপটুস। কিন্তু সে করে থোড়াই কেয়ার! কানা ছেলের নামও তো হয় পদ্মলোচন, তাই নয় কি? তবে স্কুলের খাতায় তার ছেলেমেয়েরা বাপের আসল নামটা লেখে! সময় পেলে ওদের কাছেই বাপের আসল নামটা জিজ্ঞাসা করে নেবো’খন!
তো, একদিন কিপটুস পাক্কা ২০০ টাকায় একটা পাঞ্জাবী কিনে ফেললো! পুরো গ্রামে তোলপাড়! এতো টাকার পাঞ্জাবী কিপটুস নিজের পয়সায় কিনে এনেছে? সবাই ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে ওর বাড়িতে এলো। অবশ্য ওর বাড়িতে কাউকেই চা দিয়ে ‘অপমান’ করা হয়না! তবুও মানুষ আসতে লাগলো! শহর থেকেও দু’জন এসেছিলো! আহা বেচারারা! জ্যান্ত মিউজিয়াম দেখে তারাও খালি মুখে ফেরত গেলো!
পাঞ্জাবীটা ‘একটু’ ঢিলা। চেষ্টা করলে ওটার ভিতর তুমি আর আমি ও অক্লেশে ঢুকে পড়তে পারতাম! ঢিলা কাপড়ে অনেক বেশী বরকত দেয় কিনা! পাঞ্জাবীটার সহ্যক্ষমতা ও মাশাআল্লাহ! ..বছর পনেরো ওটার উপরই সব প্রেশার গেলো! ‘আয়ুষ্কাল’ বলে একটা কথা তুমি অভিধানে পাবে। সে ‘কাল’ও শেষ হয়ে আসলো ধীরে ধীরে! অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেলো ওটা, সুতা ফেঁসেও একাকার! পরার মত আর থাকলোনা ওটা! শোকে দুঃখে কিপটুসের জগত টালমাটাল!
ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে অনেক দিন। বিয়ে থা করে সবাই কমবেশী সুখে আছে! বড় জামাই শ্বশুর-আব্বা-হুজুরের এই ‘মনোকষ্ট’ দেখে একটা ‘ব্রান্ড-নিউ-ব্রান্ড’ পাঞ্জাবী ‘তোহফা’ দিয়েই ফেললো! কিপটুসের মুখে হাসি ফুটলো আবার!
যা গরম পড়েছে! ঘেমে দরদর সবাই। রুমাল দরকার। পুরনো পাঞ্জাবীটা কেটেকুটে অনেকগুলো রুমাল পাওয়া গেলো! রুমালগুলো ও জব্বর সার্ভিস দিলো! কিন্তু সেগুলোও ভীষণ নোংরা হয়ে গেলো একসময়! মনের ভিতর শেষবিদায়ের ‘তকমা’ লাগিয়ে রুমালগুলোকে ‘চিতা’য় চড়ানোর চিন্তা করলো কিপটুস! কোন কাজে না লাগিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করবে কিপটুস? অবিশ্বাস্য! কিন্তু একদিন ওগুলোকে সত্যি সত্যি পুড়িয়ে শিশিতে ছাই ভরে সবার চোখের সামনে ধরলো কিপ্টুস! সবাই অবাক! দিন বদলে গেছে!
একদিন ভোরে শিশিভর্তি ছাই নিয়ে কিপটুস চললো পুকুরঘাটে। ওই ছাই দিয়ে দাঁত মেজে অনেকক্ষণ ধরে কুলকুচি করে কুলি ফেললো পুকুরের পানিতেই! শক্ত মাড়ি উজ্জ্বল দাঁত!
বাড়ি ফেরার সময়ও তার আফসোস রয়ে গেলো... “ইস! পুরো দুইশো টাকা শেষ পর্যন্ত পানিতেই গেলো!”
বৃহস্পতিবার, ২ আগস্ট, ২০০৭
নতুন অধ্যায়!
বুম!!!
হঠাত করেই যেন বড় হয়ে গেলাম! পড়াশুনায় একটা ‘যতি’। নতুন চাকরী এবং প্রথম চাকরী! আগের মুহুর্তগুলোর সব উত্তেজনা যোগদানের সঙেগ সঙেগই বোতলবন্দী হয়ে গেলো! এ যেন একটা সেমিস্টার শেষ করে আরেকটা সেমিস্টারের শুরু!
হলে থাকার সময় মাঝে মাঝে সকালের ‘প্রথম’ সূর্যকে সালাম জানিয়ে ঘুমাতে যেতাম। আর এখন সূর্য ঊঠে আমাকে দেখে কপালে হাত ঠেকায়। এটুকুই পার্থক্য! মূল ঘটনা কিন্তু একই থাকলো, তাইনা? সকাল সকাল সুর্যিমামার সাথে কুশলাদি বিনিময় হয়ে যায়!
ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশী কষ্টে থাকে কারা বলুনতো? ছিন্নমূল আর বস্তিবাসীরা? হয়ত তারাই! কিন্তু তাদেরকে হিসাবের বাইরে নিলে সবচেয়ে কষ্টে দিন কাটে ব্যাচেলরদের! আমি এই গ্রুপের অন্যতম নবীন সদস্য! যখন পড়াশুনা করতাম তখন কোন গুরুদায়িত্ব এলে মুখ ঘুরিয়ে খুব সহজেই বলা যেতো... “আমার ক্লাস আছে”...কিংবা আরেকটু ভাব ‘গাঢ়’ করে “পরীক্ষা আছে...পড়তে পড়তে মাথা খারাপ”! কিন্তু এখন সে অজুহাতের গুড়ে ‘কিং ব্রাণ্ড সিমেন্ট’! হল ছেড়ে ‘উদ্বাস্তু’ হবার পর ‘জামাত’ করে মেসে থাকা শুরু হলো আমার বন্ধুদের। আমি একদিক দিয়ে ‘একটু’ ভাগ্যবান! আমি পেলাম মামার বাসা! কিন্তু তৃপ্তির ঢেকুর আর তুলতে পারি কোথায়? মামা যে নিজেই ব্যাচেলর! নিজেকে নিয়েই হয়রান। তার উপর এখন আমি যেন ‘পাঁচমণী’ ট্রাকে আঠারো-মণের বস্তা!
খুব সকালে দোকান থেকে পরোটা-ভাজি খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। সকালে অফিসে যাওয়াটা বেশ আরামের। ঢাকা শহরকে তখন দিব্যি নিউইয়র্ক বলে চালিয়ে দেয়া যায়! ছিমছাম- নিরিবিলি-যানজটবিহীন ঢাকা দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়! দেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে ‘আরো’ বেশী আশাবাদী হয়ে উঠি! রামপুরা থেকে উত্তরা- এই রুটে বাসের ওভারলোড! একটাতে উঠে পড়লেই আমার অফিস!
অফিসে আমি কি করি?
ঢুকেছি ‘Trainee Engineer’ হিসাবে...প্রথমদিকের আসাইনমেন্টগুলো ঠিকঠাক করে দিতে পারলে...ক’মাস পর পার্মানেন্ট! আমরা ওখানে কম্পিউটারের সামনে বসে CAD এ ডিটেইলিং এর কাজ করি। যাদের এ ব্যাপারে খুব একটা ধারণা নেই তাদেরকে জ্ঞান দেবার লোভ আর সামলাতে পারলাম না! (জ্ঞান আর উপদেশ এদেশে এখনও ফ্রী সার্ভিস!)। একটা ‘স্ট্রাকচার’ কে মাটির উপর ‘সুস্থ্য-সবল’ ভাবে দাঁড় করাতে গেলে অনেকগুলো ধাপ পার হয়ে আসতে হয়। সহজ ভাবে বলতে গেলে... জিওটেকনিক্যাল সার্ভে ... আর্কিটেকচারাল ডিজাইন ... স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ... ডিটেইলিং ... কন্সট্রাকশন। আমাদের দেশে ‘RCC-work’ বেশী, সেজন্য ডিটেইলিংটা তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়না। এ কাজটা ফিল্ডে ‘Foreman’ ই করে ফেলতে পারে! আমাদের প্রতিষ্ঠান আমেরিকায় অবস্থিত ‘স্টিল স্ট্রাকচারের’ ডিটেইলিং করে থাকে। দেশের কোন কাজ এখনও করেনি! ক্যালকুলেশনে এক ইঞ্চির ‘৮ ভাগের ১ ভাগ’ গোলমাল হলেও ১০০ তলা ভবন মুহুর্তেই ‘নাই’ হয়ে যাবে! তাই ‘ডিটেইলিং’ খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ! মানে আমরাও গুরুত্বপূর্ণ! হে হে হে!
অফিসের পরিবেশটা খুব ফ্রেন্ডলী...একটু বেশি-ই!
সবই ঠিক ছিলো শুধু...
চিলেকোঠায় খাটের উপর একটা বিছানা পাতা আছে! ওটা দেখলেই মনে হয় একটু ঘুমিয়ে নিই! মাঝে মাঝে চোখ খোলা রেখেই ঘুমে ঢুলতে থাকি! কোন ‘পরমাসুন্দরী’র উপস্থিতি অগ্রাহ্য করা যায় খুব সহজেই ... কিন্তু দুপুরে খাবার পর নরম বিছানা দেখে না ঘুমিয়ে থাকা ......!
এ যে ‘অসাধ্যসাধন’ চেষ্টা!