সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০০৭

বিজাতীয় ভাষা শিখতে গিয়ে...

বছর তিনেক আগে হঠাত মাথায় ভুত চাপলো...শখ হলো যেকোন একটা বিজাতীয় ভাষা শেখার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Institute of Modern Language বিভিন্ন ভাষার কোর্স অফার করে! ওদের বিল্ডিংটার করিডোর দিয়ে হাঁটলে নানারকম কিচির-মিচির শোনা যায়। কিন্তু কোন ভাষায় পদ্য লিখবো, সেটাই ঠিক করতে পারলাম না। সবাই বললো, ফ্রেঞ্চ শেখো। কানাডা গেলে কাজে লাগবে। কিন্তু নাকিসুরে উচ্চারণ আমার পছন্দ নয়। শেষে নিজের নামটাও উচ্চারণ করতে হবে...আঁরাঁফাঁ(ত)। (শুনেছি, এর নাকি উচ্চারণ নেই। অনেকটা এর মত উচ্চারণ!)। আমার বন্ধু মনি অঁলিয়স ফ্রঁসেস এ ফ্রেঞ্চ শিখতো। ফ্রেঞ্চকে বেনিফিট অফ ডাউট দিতে গিয়ে বুয়েটের এক ফাইনাল পরীক্ষায় একটা ভাইটাল-উইকেট হারিয়ে ফেললো! জীবনে প্রথম বারের মত ফেল ওর! তাই ফ্রেঞ্চ-ভীতিটা আমার ছিলোই। জার্মান ভাষাকেও অনেক গুটেনটাগ করতে বললো। কিন্তু জার্মান বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা নেই, আছে লটারী। রিস্ক নিলাম না আর। কি করি?? আমাদের এনভায়রনমেন্ট ল্যাবে একটা যন্ত্রের গায়ে জাপানী ভাষায় কিসব আবোল-তাবোল লেখা। খুব জানতে ইচ্ছে করতো কি লেখা ওইখানে। তাই ভর্তি-ফর্মে শেষ মুহুর্তে জাপানিজকেই আত্মীকরণ করলাম! আমার দেখাদেখি ইশতিয়াক ও!

লা লা লা লা...মেরা জুতা হ্যায় জাপানী...লা লা লা!

তুমুল উত্তেজনা নিয়ে ক্লাস শুরু করলাম। এমনিতেই আমার বাংলা জ্ঞানের অবস্থা তথৈবচ। কোথায় আর কোথায় , এ প্রশ্নে প্রায়ই হোঁচট খাই। আর দুয়েকলাইন ইংলিশ ঝেড়ে চেক করতে হয়, সামনের পাটির দাঁতগুলো যথাস্থানে আছে কিনা! তবুও নিহোং-গো(জাপানীজ) এর ব্যাপারে আমি আশাবাদী! দেশি একজন টিচারই ক্লাস নেন। আরো ভরসা পেলাম! প্রথম প্রথম যা পড়াতেন সবই পারতাম! কিন্তু আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ট্রাজেডিক হয়ে উঠতে লাগলো! যে ভাষায় ১৮০০০ বর্ণ মতান্তরে আরো বেশি, সেই ভাষা আয়ত্ত করা যা তা কথা না! ৩ সপ্তাহের ভিতর ইশতিয়াক জাপানী ভাষাকেই সায়োনারা জানিয়ে ফেললো! আমি তবুও কষ্ট সয়ে চালিয়ে গেলাম!

আমাদের স্যার যতটা পড়ান তার চেয়ে রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন! স্যার ছিলেন লীগ-পন্থী আর প্রতিটা ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ক্লাসে একজন ছাত্রদল-নেতা ও উপস্থিত ছিলেন! ফলে সবসময় যা হয় তা-ই হত! প্রায় প্রতিদিন ই আলোচনা দীর্ঘায়িত হতে হতে ক্লাসের অনেকটা সময় খেয়ে ফেলতো! আমরা উপস্থিত আমজনতা দুই-জ্ঞানী ব্যাক্তির জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চিবুকে হাত রেখে শুনতাম! এছাড়া জ্যোতিষশাস্ত্রে স্যারের অসীম কৌতুহল! সাগ্রহে-সানন্দে ঘোষণা করলেন, তিনি হাত দেখতে পারেন। সংগে সংগে তার অনেক শিষ্য জমে গেলো! এক অত্যুতসাহী ছাত্র বলেই ফেললো, স্যার, আমার হাতটা একটু দেখে দিন!। এই অনুরোধে স্যারের মুখে হাজার পাওয়ারের টিউবলাইট জ্বলে উঠলো! প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারমশাই পিটুনি দেবার আগে যেভাবে হাত বাড়িয়ে রাখতে বলতেন, সেভাবেই সবাই হাতের তালু এগিয়ে দিলো স্যারের দিকে! কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাগ্যগণনা-লাকভেল্কি-তুকতাক সবসময়ই এড়িয়ে চলি! তাই আমার মুঠি বন্ধ!

স্যার একেকজনের হাত দেখেন আর বিভিন্ন সৌভাগ্যসূচক কথা বলেন! সম্ভাব্য বিপদের রক্ষাকবচের কথাও বলে ফেলেন বিনা পারিশ্রমিকে! একজন জিজ্ঞেস করলো, সবচেয়ে ভালো হাত কোনটা? বিশেষজ্ঞ মতামত এলো ... যার ডানহাতের তালুতে ইংরেজী ‘M’ স্পষ্ট আর দীর্ঘ। (M for Money??!) অনেকের হাতে ‘M’ এর বদলে ‘N’ আছে! তারা কলম দিয়ে তখনই ‘M’ এঁকে ফেললো!

সবশেষে আমার পালা! আমি তখনও বজ্রমুষ্ঠি! স্যার হাত দেখতে চাইলে আমি গাইগুঁই করতে থাকি! পিছন থেকে একজন সাহস দিলো, আরে ভাই, এটা স্রেফ ফান। দেখান না আপনার হাতটা! বজ্রমুষ্ঠি শিথিল হলো আমার! হাতের তালু দেখে স্যারের চোখ ছানাবড়া!(ছানাটা ভেজাল উপকরণে তৈরী নয়!) এত স্পষ্ট ‘M’ নাকি তিনি নাকি আগে কখনই দেখেননি! (আমি অবশ্য বুদ্ধি হবার পর থেকে দেখে আসছি! এজন্যই বোধহয় বলে, অভিজ্ঞতা হয় পর্যবেক্ষণে, বয়সে নয়!)। সবাই দেখতে এলো আমার হাতের তালু! এমনকি যেসব মেয়েরা সবসময় ভাব নিয়ে ক্লাসে আসতো, তারাও সেদিন যেচে কথা বলতে এলো আমার সাথে!

আহ! কী শুভক্ষণ!


পাদটীকাঃ

১. কোর্সটা আমি কমপ্লিট করতে পারিনি। তাই আমার জাপানীজ জ্ঞান আপনার মতোই!

২। জ্যোতিষশাস্ত্রে কারো অনুরাগ থাকলে আমার কথায় আহত হবেননা! প্লিইইইইজ! এই ব্যাপারে অবিশ্বাস আমার একান্ত ব্যক্তিগত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন